
বাঙালিদের কাছে দার্জিলিং খুবই পছন্দের জায়গা. এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন সময়ে দার্জিলিং ঘুরতে গেছিলাম. ইচ্ছে ছিল বর্ষার দার্জিলিং কে দেখার. সেই মতো ঠিক করে ফেললাম বর্ষাকালে এবারের গন্তব্য দার্জিলিং. তিন দিনের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম. ভোরবেলা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরে ট্রেনে চেপে এনজিপি রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত গেলাম. স্টেশন থেকে বেরোতেই অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল. কোনরকমে ছাতা মাথায় দিয়ে একটি শেয়ার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম. কিছুক্ষণ পর গাড়ি ছেড়ে ও দিল. অফিশিয়াল ট্রিপে দার্জিলিং ঘুরতে এসে অম্বর দা ও অনির্বাণ দা যখন জানতে পারল আমিও যাচ্ছি দার্জিলিং. সেই শুনে দুই দাদা ও আমার জন্য দার্জিলিঙে অপেক্ষা করছিল. ইতিমধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল. টয় ট্রেনের লাইন কে পাশে রেখে, চা বাগানের সবুজ গালিচা পেরিয়ে দূরের মেঘে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতে পাহাড়ের বাক বেয়ে উঠতে থাকলো গাড়িটি. রোহিনী পার করার পরেই মাঝে মধ্যেই কুয়াশা যেন ঘিরে ধরছিল গাড়িটিকে. তার মধ্য দিয়ে আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে ছুটে চলেছে. কার্শিয়াং ঢোকার কিছুটা আগেই গাড়ি খারাপ হয়ে যায়. কোনো ভাবে কার্শিয়াং পর্যন্ত এসে গাড়ি পাল্টে পুনরায় দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম. কুয়াশাঘেরা বৃষ্টিমাখা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম দার্জিলিং টয় ট্রেন স্টেশন এর সামনে. সেখান থেকে পায়ে হাটা রাস্তা গেছে. ওই রাস্তাটি পুরোপুরিই খাড়া. তবে খুব কম সময়েই যাওয়া যায়. ওই পথ দিয়ে বিগ বাজারের সামনে গিয়ে উঠলাম. ততক্ষণে অম্বর দা ও অনির্বাণ দা কে ফোন করে জানলাম আমার জন্য অপেক্ষা করছে গ্লেনারিজ এর সামনে. দাদাদের সঙ্গে দেখা করলাম. এরপর কেভেন্টার্স এ গিয়ে আড্ডা ও খাওয়া দাওয়া ও হল।এরপর দাদাদেরকে বিদায় জানিয়ে আমিও চলে গেলাম একটি হোটেলে.



হোটেলে চেক ইন করে কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম. হাঁটতে হাঁটতে আবার দার্জিলিং টয়-ট্রেন স্টেশনের দিকে আসলাম. স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে আগামীকালের জন্য জয় রাইড এর টিকিট কেটে নিলাম. তারপর সেখান থেকে একটি গাড়ি রিজার্ভ করে দার্জিলিং শহরের আশেপাশে কিছু মনাস্ট্রি ঘুরতে বেরোলাম. কিছুদুর যাবার পরেই ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হলো. বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই গাড়ি থেকে নেমে ছাতা মাথায় দিয়ে প্রথমে গেলাম দার্জিলিং শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ইগা চোয়েলিং মনাস্ট্রি. এই মনাস্ট্রি স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে. মনাস্ট্রির দেওয়ালে আঁকা বিভিন্ন চিত্র দেখে বেরোনোর সময়ে হঠাৎই চোখে পড়লো ঠিক পাশের একটি ঘরে একজন প্রদীপ জ্বালাচ্ছে. ওই ঘরে পা দিতেই চারিদিক কেমন যেন শান্ত এবং স্নিদ্ধ হয়ে গেলো. সেই পরিবেশটি ক্যামেরাবন্দি করে ফের রওনা হলাম. সেখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পরেই পৌঁছলাম দুঙ্গন সামতেন চোয়েলিং মনাস্ট্রি.যা ঘুম মনাস্ট্রি নামেই বেশি পরিচিত. শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মনাস্ট্রিটি. টয়-ট্রেন এর লাইন পার করে মূল ফটক পেরিয়ে গেলাম মনাস্ট্রিতে ঢুকলাম. মনাস্ট্রি দেখে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম. ইতিমধ্যে বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে. এরপর গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো ডালি মনাস্ট্রিতে. কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মনাস্ট্রিটি বন্ধ ছিল. তাই বাইরে থেকেই ক্যামেরাবন্দি করলাম. ম্যালের কাছে গিয়ে গাড়িটি আমাকে ছেড়ে দিলো. তারপর হাঁটতে হাঁটতে ম্যালে গিয়ে পৌঁছলাম। কেউ চা এ চুমুক দিতে দিতে গল্প করছে , আবার কেউ গরম গরম ধোয়া ওঠা মোমো খেতে খেতে ম্যাল থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন. চারপাশটা ঘুরতে ঘুরতে আমার ও খিদে পেয়ে গেল। গরম গরম মোমো খেয়ে ম্যালের ডানদিকের রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম. কিছুটা যাওয়ার পরেই দেখলাম মেঘের আড়ালে মাঝে মধ্যে পাহাড়ের কোণে থাকা বাড়িগুলো উঁকি দিচ্ছে. ম্যালের চারপাশটা একবার প্রদক্ষিণ করে হোটেলে ফিরলাম. কিছুক্ষন হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়লাম. ইতিমধ্যেই সন্ধে নামা শুরু করেছে. দার্জিলিং এর অন্যতম পুরোনো বেকারি গ্লেনারিজে গিয়ে কফি খেতে খেতে ক্যামেরা এ তোলা ফটো গুলো দেখতে থাকলাম. কিছুক্ষন পরেই বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো. বৃষ্টি থামতেই ছাতা মাথায় দিয়ে বর্ষাময় ম্যালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলাম. রাত ৮ টা বাজতেই ফিরে এলাম হোটেলে.



পরদিন সকাল ৬ টা নাগাদ ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ম্যালের দিকে রওনা হলাম. ম্যালে পৌঁছে দেখি অনেকে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে. আমিও ম্যালের ডানদিকে হাঁটতে শুরু করলাম. কিছুদুর যাবার পর ডান দিকে তাকাতেই দেখলাম মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা. বর্ষাকালে এরকম দৃশ্য দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেছিলাম. প্রথমে দু-চোখ ভরে সেই অপরূপ দৃশ্য প্রাণ ভরে দেখে নিলাম. তারপর ক্যামেরায় সেটি ক্যামেরাবন্দি করে রাখলাম. এরপর ম্যালের চারপাশটা ঘুরে প্রাতরাশ সেরে হোটেল থেকে চেক আউট করলাম. গতকালই দার্জিলিং টয় ট্রেন এর জয় রাইড এর টিকেট কেটে রেখেছিলাম. সেই মতো স্টেশনের দিকে রওনা হলাম. অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল বর্ষায় স্টিম ইঞ্জিনের টয় ট্রেনে চেপে ঘুরে বেড়াতে. কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টিম ইঞ্জিনে টয় ট্রেনটি প্লাটফর্মে চলে আসলো. ট্রেনে চেপে বসতেই কু ঝিকঝিক করে ট্রেন ছেড়ে দিল. কিছুদূর যাওয়ার পরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল. তার মধ্যেই পাহাড়ের বেয়ে ট্রেন ছুটতে থাকলো. কখনো বাড়ি ঘর এর পাশ দিয়ে, আবার কুয়াশামাখা রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে বাতাসিয়া লুপে পৌছালো টয়-ট্রেন টি. সামান্য কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর পুনরায় ঘুম টয় ট্রেন স্টেশন এর উদ্দেশ্যে রওনা হল. সেখানে পৌঁছে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়ালো টয়-ট্রেনটি. মিউজিয়াম এবং স্টেশন দেখে ফের দার্জিলিং টয় ট্রেন স্টেশনের দিকে রওনা হলো. দার্জিলিং টয়-ট্রেন পৌঁছে পুনরায় আরেকটি নতুন গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম.
কিভাবে যাবেন- শিয়ালদাহ , হাওড়া, কলকাতা স্টেশন থেকে অসামগামী বা নিউ জলপাগড়ী গামী ট্রেন এ এনজিপি নেমে সেখান থেকে শেয়ার গাড়ি তে বা গাড়ি রিসার্ভ করে দার্য্যেলিং যাওয়া যায়. এনজিপি থেকে দার্জিলিং এর দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার. কেউ উড়োজাহাজে আস্তে চাইলে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে গাড়িও নিয়ে যেতে পারবেন.
কোথায় থাকবেন- দার্জিলিং শহর এবং ম্যাল এর আশেপাশে বিভিন্ন বাজেটের হোটেল রয়েছে.



ON THE WAY TO ZOO

